নৃবিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীয়তা আলােচনা কর


প্রশ্নঃ নৃ-বিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীয়তা আলােচনা কর।
অথবা, নৃ-বিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব আলােচনা কর।
অথবা, নৃ-বিজ্ঞান পাঠের আবশ্যকতা আলােচনা কর।

ভূমিকাঃ সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে নৃ-বিজ্ঞান অন্যতম। নৃ-বিজ্ঞানকে মানুষের সামগ্রিক বা পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়ন বলা হয়। এজন্য নৃ-বিজ্ঞান মানুষকে একদিকে যেমন জীব হিসেবে অধ্যয়ন করে, অন্যদিকে তেমনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীব হিসেবে তার সমাজ ও সংস্কৃতিকে অধ্যয়ন করে। এজন্য নৃ-বিজ্ঞানী Beals এবং Hoijer বলেন, “The anthropologies Combines in one discipline the approaches of both biological and the social sciences.”

নৃ-বিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীতা ও গুরুত্বঃ নৃ-বিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীতা ও গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে নৃ-বিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্ব বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো-


(১) মানুষ সম্পর্কে জ্ঞান লাভঃ নৃ-বিজ্ঞান পাঠে মানুষ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা যায়। নৃ-বিজ্ঞান মানুষের জৈবিক ও সাংস্কৃতিক উভয় দিক নিয়ে আলােচনা করে। এভাবে মানুষকে দু’দিক থেকে গবেষণা করে বিধায় নৃ-বিজ্ঞান একটি ব্যাপক ও পূর্নাঙ্গ ব্যবহারিক বিজ্ঞান হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। মানুষ ও তার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে নৃ-বিজ্ঞানের চর্চা অনস্বীকার্য। কেননা জৈবিক ও সাংস্কৃতিক এ দু’টি সত্তার মধ্যেই মানুষের প্রকৃত পরিচয় নিহিত। নৃ-বিজ্ঞানী পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নেন বিধায় মানুষ সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দিতে সক্ষম। সে কারণে নৃ-বিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।

(২) প্রশাসনিক কাজকর্মঃ নৃ-বিজ্ঞানী তার গবেষণা দ্বারা সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে যে জ্ঞান অর্জন করেন তাতে তার পক্ষে প্রশাসনিক কাজকর্ম করা একদিকে যেমন সহজ হয়, অন্যদিকে প্রশাসনিক উন্নতি আনার জন্য কার্যকরী সুপারিশ করা সহজ হয়। দেশ, জাতি, সংখ্যালঘু সমস্যা, সাম্প্রদায়িক মত পার্থক্য ইত্যাদিতে জর্জরিত যে দেশ- সে সব দেশে নৃ-বিজ্ঞানের জ্ঞান আহরণ অপরিহার্য। কেননা নৃ-বিজ্ঞানী ঐ সকল সমস্যা সমাধানে উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সকলের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গবেষণা কাজ করে থাকেন। এতে একদিকে যেমন সমস্যা নির্ণয় করা যায়, অন্যদিকে সঠিকভাবে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে দেশের প্রশাসনিক অবকাঠামােতে উন্নয়ন করা সম্ভব হয়। এ কারণে নৃ-বিজ্ঞান পাঠ করা একান্ত অপরিহার্য।


(৩) অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জানাঃ কোনাে দেশের উৎপাদন, বন্টন, ভােগ, সঞ্চয় প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানতে নৃ-বিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা নৃ-বিজ্ঞান মানুষের অর্থনৈতিক সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে আলােচনা করে।

(৪) রাজনৈতিক অবস্থা বিশ্লেষণঃ মানব সমাজ থেকে কীভাবে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূর করা যায়, কীভাবে দেশের উন্নয়নের গতিকে তরান্বিত করা যায়, রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতার উৎস, নেতৃত্বের কাঠামাে, দলনেতার ভূমিকা ইত্যাদি নৃ-বিজ্ঞান অধ্যয়নের মাধ্যমে জানা যায়।

(৫) উপজাতি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানঃ বর্তমান পৃথিবীতে ক্ষুদ্র জাতি গােষ্ঠির লােকজন নানা সমস্যায় জর্জরিত। একজন নৃ-বিজ্ঞানী ক্ষুদ্র জাতি গােষ্ঠির সমস্যাবলি অতি সহজেই চিহ্নিত করে সমাধানের পথ নির্দেশ করতে পারেন। তাই নৃ-বিজ্ঞান পাঠ করা আবশ্যক।

(৬) সমাজ কাঠামাে পাঠঃ নৃ-বিজ্ঞানী; বিশেষ করে সামাজিক নৃ-বিজ্ঞানী ক্ষুদ্রাকৃতির সমাজ সম্পর্কে নিবিড় গবেষণা করে সেখানকার সমাজ কাঠামাের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে পারেন। আদিম কিংবা আধুনিক সব সমাজের বাস্তব কাঠামাে বিশ্লেষণে নৃ-বিজ্ঞানী অধিকতর যত্নশীল। আর সমাজ কাঠামাে সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করতে সমাজকে অনুধাবন করা অত্যন্ত জরুরী। সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম কাঠামাে হল সমাজ কাঠামাের বিশ্লেষণ। এক্ষেত্রে নৃ-বিজ্ঞানীর গবেষণা থেকে সমাজবিজ্ঞানী বিশেষ ক্ষুদ্রাকৃতির সমাজ কাঠামাে সম্পর্কে জানতে সক্ষম হন। সুতরাং সমাজ কাঠামাের পুর্ণাঙ্গ পাঠের নিমিত্তে নৃ-বিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।


(৭) সামাজিক সমস্যার সমাধানঃ যেকোনাে সামাজিক সমস্যার বাস্তবতা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞানার্জন এবং সমস্যা লাঘবে নৃ-বিজ্ঞানী আন্তরিকতার সাথে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কোনাে সামাজিক সমস্যা নিরসনে বাস্তব সমস্যার প্রকৃতি ও কারণ সম্পর্কে গবেষণা করে সমাধানের পন্থা ও দিকনির্দেশনা দেয়াও তার কাজ। কাজেই সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য নৃ-বিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে।

(৮) শ্রমিক অসন্তোষ দূরঃ কলকারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ দূরীকরণে এবং শিল্পের সাথে জড়িত প্রশাসনিক কাজে নৃ-বিজ্ঞানের জ্ঞান সহায়ক ভূমিকা পালন করে। নৃ-বিজ্ঞান যেহেতু মানুষের আচার-আচরণ, ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করে সেহেতু তার পক্ষে সহানুভূতিশীল সমাধানের পথ খোঁজা সহজ হয়। অতএব শ্রমিক অসন্তোষ দূরীকরণ ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা রক্ষার্থে নৃবিজ্ঞানের জ্ঞান অপরিহার্য।

(৯) পরিকল্পনা বাস্তবায়নঃ কোনাে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নে নৃ-বিজ্ঞানের জ্ঞান বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে নৃ-বিজ্ঞানীর বাস্তব জ্ঞান কোনাে পরিকল্পনার উপযােগিতা ও কার্যকরি বিশ্লেষণে সহায়ক হতে পারে। আবার গৃহীত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসাবে বিবেচিত হয় এমন প্রচলিত আচার-বিশ্বাস ও সংস্কারের পরিবর্তন এনে জনসাধারণকে পরিকল্পনা গ্রহণে উৎসাহিত করতে পারেন।

(১০) শিক্ষাক্ষেত্রেঃ আন্তর্জাতিক সাহায্যকারি সংস্থা দরিদ্র তথা উন্নয়নকামী দেশে শিক্ষার প্রসার বৃদ্ধিতে নৃ-বিজ্ঞানীর গবেষণার ফলাফল কে কাজে লাগান। সে কারণে নৃ-বিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে।


(১১) স্বাস্থ্য ও জীবনমান উন্নয়নঃ কোনাে দেশের স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন এবং জীবনমান বৃদ্ধিতে নৃ-বিজ্ঞানের ভূমিকা অপরিসীম। স্বাস্থ্য ও জীবনমান সম্পর্কে সমাজবাসীর আচার বিশ্বাস মনােভাব সম্পর্কে নৃ-বিজ্ঞানী প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেন। তাই এ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে স্বাস্থ্য সেবার মান বৃদ্ধির সাথে সাথে জীবনমান সম্পর্কিত অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে নৃ-বিজ্ঞান পাঠ করা অত্যাবশ্যক।

পরিশেষঃ পরিশেষে বলা যায় যে, নৃ-বিজ্ঞান মানুষের সামগ্রিক ও পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়ন বিষয়ক একটি বিজ্ঞান। নৃ-বিজ্ঞান পাঠে মানুষের ব্যক্তিগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। পাশাপাশি মানব জীবনে বহুমুখী সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা বর্তমান। তাই নৃ-বিজ্ঞান পাঠের প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

টপিক